নড়বড়ে-ভাঙাচোরা বাস,লাইসেন্সবিহীন চালক,নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতা—সবই দৃশ্যমান। মন্ত্রী,পুলিশ বা সরকারি গাড়ির চালকও যে ‘ফিটনেসবিহীন’ সেটা রাজধানীর শিক্ষার্থীদেরই আবিষ্কার।
সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনে যান। সড়কে দৌড়ঝাঁপ করেন। কখনো নিজেই যাত্রী সেজে বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না পরীক্ষা করেন। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে মৌলিক কোনো উদ্যোগ বা কর্মকাণ্ড নেই।
ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প নামে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দুটি সমীক্ষা করে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। এই সমীক্ষা বলছে,যানবাহন ব্যবহার করে ঢাকায় প্রতিদিন ৩ কোটি ৩০ লাখবার যাতায়াত হয়। এর ৭২ শতাংশ যাতায়াত হয় বাসে। আর বাস ও অটোরিকশায় যাতায়াত হয় ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকিটা কার ও অন্যান্য যানবাহনে।
ঢাকাবাসীর ভরসা যে বাস,এর চলাচলের অনুমোদন দেওয়া, ভাড়া নির্ধারণ,ফিটনেস সনদ দেওয়া—সবই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু তাদের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া, থামার জায়গা মানছেন না মালিক-শ্রমিকেরা। ফিটনেস সনদ নেই এমন বাসও চলছে রাজধানী শহরে। যেগুলোর ফিটনেস সনদ আছে,সেগুলো বাসেরও ছাল-বাকল নেই।
যানজটে আর্থিক ক্ষতি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে,যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এর ফলে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়,২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার,যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি
গত বছর আগস্টে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় এসেছে,দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৫ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন। এই হিসাব যাত্রী কল্যাণ সমিতির। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণহানি প্রায় ২১ হাজার।
প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা:
তিন মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১.আন্ডারগ্রাউন্ড রেল :
চলমান মেট্রো রেলের পাশাপাশি আন্ডারগ্রাউন্ড রেল সিস্টেম চালুর বিষয়টি অগ্রগন্য প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে।
২.আউটার সার্কুলার রোড:
সিটি করপোরেশন এলাকার চারদিকে আউটার সার্কুলার রোড নির্মাণ করা হবে। এরমাধ্যমে আন্ত:জেলার পরিবহনগুলো যানজটের ভোগান্তি ছাড়া গন্তব্যে পৌছাতে পারবে।
৩.এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ: ৬ থেকে ৮ লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মান করা হবে। এ সব লেনে আলাদা আলাদাভাবে গাড়ীর গতি নির্ধারন করে দেয়া হবে।
৪. বাস স্টপেজ উন্নতকরণ:
সিটি করপোরেশনের বাস স্টপেজের যাত্রী ছাউনি, টিকেট কাউন্টার এবং বাস থামার রোড মার্কিংয়ের এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৫. অনস্ট্রিট পার্কিং:
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আরও নতুন স্থান চিহ্নিত করে রোড মার্কিং করে অনস্ট্রিট পার্কিংয়ের পরিমাণ বাড়ানোর হবে।
৬. রোড ডিভাইডার ঊর্ধ্বমুখী করণ:
সড়কে ঝুঁকি নিয়ে পথচারীদের রাস্তা পারাপার বন্ধে রোড ডিভাইডার উঁচু করা হবে।
৭. গণপরিবহনের শৃঙ্খলা:
রাজধানীর বাস সার্ভিসে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য বাসগুলো নির্দিষ্ট স্টপেজে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করবে,চলার পথে দরজা বন্ধ করে চলাচল করবে,যাত্রীরা প্রতিটি কাউন্টার হতে টিকেট ক্রয় করে লাইন দিয়ে বাসে উঠবে।
৮. রোড মার্কিং নিশ্চিতকরণ:
সড়কের ট্রাফিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রোড মার্কিং (স্টপলাইন, জেব্রা ক্রসিং, ল্যান মার্কিং, এরো মার্কং ইত্যাদি) রোড মার্কিং মুছে গেলে নিয়মিতভাবে সিটি করপোরেশন রোড মার্কিং পুনস্থাপন করার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
৯. ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা:
সিএএসই প্রকল্প এবং অন্যান্য প্রকল্পের বাস্তবায়নাধীন ট্রাফিক সিগন্যালগুলো দ্রুত ত্রুটিমুক্ত করে চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১০. দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করা:
সারা বাংলাদেশে গাড়ির সংখ্যা আনুমানিক ৩৫ লাখ হলেও বৈধ ড্রাইভারের সংখ্যা আনুমানিক ১৮ লাখ। এ অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য সিটি করর্পোরেশনের উদ্যোগে দক্ষ ড্রাইভার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে।
১১. বাস রুট ফ্রাঞ্জাইজ করা:
সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে বাস রুট ফ্রাঞ্জিইজি করার বিষয়টি বেগবান করা হবে।
১২. বহুতল ভবনের ট্রাফিক ছাড়পত্র:
ঢাকা শহরের ১০ তলার ওপরে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ডিএমপির ট্রাফিক শাখার ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি যানজট নিরসনে বহুতল বিশিষ্ট কারপার্কিং এর ব্যবস্থা করা হবে।
১৩. স্কুলবাস চালু:
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানো ও যানজট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট রঙয়ের স্কুলবাস সার্ভিস চালু করা হবে। ডিএমপি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ করবে সিটি করর্পোরেশন।
১৪. পুশ বাটন ব্যবস্থায় পথচারী পারাপার:
পুশ বাটন ব্যবস্থা চালু করে পথচারী পারাপারের বিষয়ে ডিএমপি এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৫. এলিভেটেড পার্কিং ব্যবস্থাপনা:
ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এলিভেটেড পার্কিং ব্যবস্থা চালু করে রাস্তায় অবৈধ পার্কিংসহ যানজট কমানো সম্ভব।
১৬. নির্মাণ সামগ্রীর অপ্রয়োজনীয় অংশ রাস্তা হতে দ্রুত অপসারণ:
সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থা ঢাকা শহরের সড়কের উন্নয়ন কাজ করার পর অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী,মাটি,বালি ইত্যাদি অনেক সময় দীর্ঘদিন সড়কে ফেলে না রেখে দ্রুত নিস্কাশন করতে হবে।
১৭. স্টেকহোল্ডার গণের সমন্বয়ে বৈঠক:
রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারগণের সমন্বয়ে নিয়মিত বৈঠক করে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৮. ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট:
ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে স্টপ লাইন বরাবর গাড়ি দাঁড় করানো,জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পথচারী পারাপার,বাম লেন পরিষ্কার রাখা,ইলেকট্রনিক বা হাত সিগন্যাল দিয়ে নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি চালানো ইত্যাদি ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।
১৯. ফুটওভার ব্রিজ,আন্ডারপাস ব্যবহার:
পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সচেতনতা সৃষ্টি করব হবে।
২০. হর্নের ব্যবহার সীমিতকরণ:
যে কোনও যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা হবে। অপ্রয়োজনে সাধারণ হর্ন বাজানোর বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২১. ডিএনসিসি প্রস্তাবিত ইউলুপগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন:
ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশন এলাকায় কয়েকটি ইউলুপ তৈরির কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
২২. জনসচেতনতামূলক প্রচারণা:
ট্রাফিক আইন ও সড়কে শৃঙ্খলা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা চালানো হবে। এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ট্রাফিক বিষয়ে প্রচারণা চালানো হবে।।
২৩. আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের যথাযথ ব্যবহার:
ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন বহুতল ভবনে,বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের দু’পাশের ভবন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং ব্যবস্থার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।