ঢাকাকে ঘিরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর দূষণের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে। নদীগুলো দূষিত হচ্ছে শিল্প কারখানার বর্জ্যে। দূষণের কারণে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকেই মারা যাচ্ছেন। আতঙ্কিত জনগণ। পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এখন। রাজধানী পানির দূষণের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ১০টি জোনের ৫৯টি এলাকার ওয়াসার পানি বেশি দূষিত বলে আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।
গবেষনায় দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করেন। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সিদ্ধ করে পান করেন। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। ১০টি জোনের ৩৪টি পয়েন্টের পানির নমুনা পরীক্ষা করেছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। তাদের পরীক্ষায় চারটি জোনের আটটি পয়েন্টের পানি দূষিত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এসব স্থানের পানিতে ক্ষতিকর আর্সেনিক, ক্লোরিন, অ্যামোনিয়া এবং ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে।
যে বুড়িগঙ্গা নদীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী যদি তিলে তিলে ধ্বংসের মুখে পতিত হয় তাহলে রাজধানী বাঁচবে কেমন করে ? দুঃখজনক হচ্ছে- একই অবস্থার শিকার ঢাকার পাশের তিন নদী- তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা।
রাজধানীতে দুই সিটি মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। গত বর্ষায় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ঢাকার আশপাশের পাঁচটি নদী- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর ১৯ স্থানের পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষায় পানির আদর্শ মান মাত্রার সঙ্গে চরম অসামঞ্জ্যতা পাওয়া গেছে। এসব নদীর পানি ব্যবহারের একবারেই অনুপযোগী।
আমিনবাজারের ল্যান্ডফিল: সাভারের আমিনবাজারে সিটি করপোরেশনের ল্যান্ডফিল বা বর্জ্য ফেলার জায়গা। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই এখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ল্যান্ডফিল থেকে ময়লা উপচে পড়ছে এখানকার পানিতে। বাংলাদেশে ল্যান্ডফিল স্থাপনের কোনো আইনি নির্দেশনা নেই। তবে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিমানবন্দর, মহাসড়ক ও জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ল্যান্ডফিল স্থাপন করতে হবে। আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের ক্ষেত্রে এ মানদণ্ডের কোনটিই অনুসরণ করা হয় নি।
পুরনো রূপে হাতিরঝিল: রাজধানীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হয়ে ওঠা হাতিরঝিল ফিরে পেয়েছে তার পুরনো রূপে। আবারো উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে হাতিরঝিলের পানি। দুর্গন্ধে লেকের পানিতে বোটিং কিংবা পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে। নগরবাসীর নির্মল শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে যে মুক্ত বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল তার পানি দূষিত হয়ে ওঠায় হতাশ নগরবাসী। বর্তমানে হাতিরঝিলের দুর্গন্ধ এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, নাকে রুমাল চাপা ছাড়া কেউই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চলাচল করতে পারছেন না। মহাখালী, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগান, নিকেতন, রামপুরা, বাড্ডা, তেজগাঁও, মগবাজার, বেগুনবাড়ী ও মধুবাগ এলাকার ১৩টি পথ দিয়ে পানি আসে হাতিরঝিলে। এই পানির বেশিরভাগই থাকে পয়োবর্জ্য মিশ্রিত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য হাতিরঝিলে পানি নামার ৯টি পথে বর্জ্যশোধনের যন্ত্র বসানো হয়েছিল কিন্তু ইতোমধ্যেই কয়েকটি যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পানিতে ময়লা ফেলে পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অসম্ভব ব্যাপার। বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। এ তালিকায় অর্ন্তভুক্তির পেছনে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও পরিবেশ দূষণের দায়ও কম নয় বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা বলেন, নদী পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে শিল্প দূষণ, পৌর বর্জ্যের উপস্থিতি, রাসায়নিক বর্জ্য, নদীর পাশে গড়ে ওঠা মানুষের অপরিকল্পিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, গৃহস্থালি বর্জ্য, নদী দখল করে গবাদি পশুর বাসস্থান নির্মাণ, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা অসংখ্য ইটভাটা এবং নৌযান হতে নির্গত ইঞ্জিনের তেলের দূষণে পানি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। পরিকল্পনার অভাবে দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
সমাধান:
* কঠিন বর্জ্য পদার্থ পানিতে মিশতে দেওয়ার পথ বন্ধ করা হবে। মানববর্জ্য ব্যবস্থার জন্য আলাদাভাবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করা হবে।
* সড়ক সম্প্রসারণের নামে ইচ্ছামতো বাঁধ দিয়ে খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। খালগুলো ফিরিয়ে আনতে নেয়া হবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
* ঢাকার খাল-নদী তথা জলাশয়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা হবে এলাকার জনগণকে।
* ঢাকা মহানগরের জলাশয়গুলো উদ্ধারে কোন আপস নয়, এ নগরকে বাঁচাতে কাজ করতে হবে এক সাথে। কাধে কাধ মিলিয়ে।
* লেক চিহ্নিত করে যে যতটুকু দূষণ হয়েছে, তা চিহ্নিত করা হবে।
* নদীদূষণ রোধে উৎসমুখে বাঁধ দেওয়াসহ সচেতন করা হবে।