রাজধানী ঢাকা যেসব বড় সমস্যার মুখে রয়েছে তার ভেতরে আছে বিল্ডিং কোড না মানার প্রবণতা। ভয়াবহ এ প্রবণতার কারণে পুরো ঢাকা শহর এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। কোনো বিল্ডিংকে যেকোনো ঝুঁকি সহনীয় করে গড়ে তুলতে বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ করা হয়। অথচ,ঢাকার জন্য যে বিল্ডিং কোড রয়েছে, তিক্ত হলেও সত্য- রাজউকসহ দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তা যথাযথভাবে দেখে না। ভবন নির্মাণে কাঠামো কৌশল,স্থাপত্য কৌশল,ভিত্তি কৌশল,অগ্নি প্রতিরোধ,প্লাম্বিং,তড়িৎ কৌশল,যন্ত্র কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে বিল্ডিং কোডে সুস্পষ্টভাবে দিক নির্দেশনা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে আইন আছে কাগজে কলমে;বাস্তবে তার দেখা মেলা ভার।
সরেজমিন পুরান ঢাকা: কদমতলী, ডিস্ট্রিলারি রোড, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, জুরাইন, নারিন্দা, ইসলামপুর, শাঁখারীবাজার, কোতোয়ালি, বংশাল, ওয়ারী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও কমলাপুরসহ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনেক এলাকায় বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে,দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রাজউক কখনো বাসিন্দাদের এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখে না। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কোথায় রাজউকের অফিস এবং তাদেরকে যে এসব ব্যাপারে নিয়ম মেনে চলতে হবে,তাও জানেন না! তবে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ইউনিয়নগুলোর ক্ষেত্রে। এসব ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছে শ্যামপুর,দনিয়া, মাতুয়াইল,সারুলিয়া,ডেমরা,মান্ডা,দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ। ডেমরা এলাকার মহাসড়কসংলগ্ন অর্ধশত ভবন গড়ে উঠেছে বিল্ডিং কোড না মেনেই। স্থানীয় রাজমিস্ত্রিদের দিয়ে কলাম ছাড়াই ইটের গাঁথুনির ওপর দোতলা,তিনতলা ভবন গড়ে তুলছেন। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণের বালাই নেই; জায়গাও ছাড়া হয় না। রাজউক বা সরকারি কোনো সংস্থা এসব এলাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমেও মাথা ঘামায় না। কেউবা রাস্তার জায়গা বা অপরের জায়গায় ভবন নির্মাণ করছেন।
রানা প্লাজা ধসের পর রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি টেকনিক্যাল জরিপ চালিয়েছে বুয়েট। জরিপে দেখা যায়,ধানমণ্ডি এলাকার ৬৭ শতাংশ ভবনই সাত মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়,আর মোহাম্মদপুর এলাকায় তা ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এখন যদি পুরান ঢাকা ও বাসাবো,খিলগাঁও, শাজাহানপুর এলাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিল্ডিং কোডে যা আছে: বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। পরে ২০০৬ সালে এটি পার্লামেন্ট থেকে গেজেট আকারে প্রকাশ পায়,পরিণত হয় আইনে। বিল্ডিং কোডে সব ধরনের ভবনের জন্যই আলো-বাতাস চলাচল করার ব্যবস্থা,নিরাপত্তাব্যবস্থা,ভার বহন ক্ষমতা,নির্মাণপ্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত নীতিমালা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে ভবন তৈরি করার ক্ষেত্রে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিল্ডিং কোডে। নিরাপদ ভবন তৈরি করার ক্ষেত্রে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার বা বসবাস সনদ) জরুরি বিষয়। বাড়ি তৈরির পর একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর অনুমোদিত অকুপেন্সি সার্টিফিকেট অবশ্যই নিতে হবে। জাতীয় বিল্ডিং কোড তথা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হচ্ছে- ৭ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস,পরিবেশ অধিদপ্তর,গ্যাস ও বিদ্যুত বিভাগের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। এর চেয়ে উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে ফায়ার ডিটেক্টর,স্মোক ডিটেকটর,উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক।কিন্তু রাজধানীর অনেক ভবন নির্মাণে এসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
অন্তহীন অভিযোগ: অনুমোদনহীন এসব ভবন নিয়ে রাজউক ভবনে অভিযোগের অন্ত নেই, কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না রাজউক। রাজউক নিজেই উন্নয়নমূলক কাজ করে। তাই এই সংস্থার পক্ষে তদারক করা সম্ভব নয় বলেও মত রয়েছে। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেওয়ার সঙ্গে রাজউকের সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিশ্লেষকদের মতে,“ঢাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমে প্ল্যান পাস হয়, পরে ভবনের স্থাপত্য নকশা পাস হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
এর ফলে ১৪ তলার ভবন ১৮ তলা হয়। তবে রাজউক কর্মকর্তারা অদ্ভুত কথা বলছেন, “প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এসব বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে না পারলেও নিয়ম না মেনে করা সব ভবনকেই একদিন নিয়মের আওতায় আনা হবে।
আইন না মানার কারণ: বিল্ডিং কোড মানলে যে নিরাপত্তার সুবিধা পাওয়া যাবে, সে বিষয়টি অনেকেই জানেন না। অন্যটি হচ্ছে,অনেকেই মনে করেন, এটি না মেনে বাড়িঘর করলে খরচ কমবে। এছাড়া,কোড মানতে গেলে জমি ছাড়ার প্রশ্ন আছে বরং কোড না মানলে অন্যের জমির ওপরও ভবন নির্মাণ করা যায়!
কোড না মানার ফল: অগ্নিদুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না রাজধানী ঢাকার। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর আকাশচুম্বী ফারুক রূপায়ন- এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড আবার কেড়ে নেয় এক বিদেশি নাগরিকসহ ২৫ জনের জীবন। আশংকার কথা- শুধু এফআর টাওয়ারই নয়, ঢাকা মহানগরীর অন্তত ১১ হাজার বহুতল ভবন এখন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। বনানীর অগ্নিদগ্ধ ভবন এফআর টাওয়ারটির মালিক ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা নির্মাণ করেন। একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা প্রয়োজন তা পুরোপুরি ছিল না। দু-একটা ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ছিল অকেজো। এমন হাইরাইজ বিল্ডিং বানানোর ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচতলার ওপরে একটি করে নিরাপদ এলাকা থাকা জরুরি।
প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি: দুর্ভাগ্যক্রমে যদি আগুন লেগেই যায়,তাহলে তা আগে থেকে টের পেতে ব্যবহার করা হয় ফায়ার অ্যালার্ম,স্মোক ডিটেকটর ও টেম্পারেচার ক্যাপচার। এ প্রযুক্তিগুলো ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। কোনো কারণে দালানে আগুন লাগলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এটি জানান দেয় ফায়ার অ্যালার্ম ও টেম্পারেচার ক্যাপচার। আগুন লাগলেই পুরো দালানে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ পায়। ব্যবহার করা হয় স্মোক ডিটেকটর। ঘরে ধোঁয়ার অস্তিত্ব টের পেলেই এটি সচল হয়ে যায়। এসব প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকে ওয়াটার স্প্রিঙ্কলার ও ফায়ার সাপ্রেশনার। দালানে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো চালু হয়ে যায় এবং তীব্র বেগে পানি ও আগুন নেভানোর বিশেষ রাসায়নিক ঝরতে শুরু করে। এতে আগুন দ্রুত নিভে যায়। আগুন পুরোপুরি না নিভলেও পানি ও বিশেষ রাসায়নিক ফোম আগুনকে ছড়াতে দেয় না। এসব স্প্রিঙ্কলার চালু রাখতে দালানে রাখা হয় বিশেষ রিজার্ভ পানির ট্যাঙ্ক। মোটর দিয়ে এ ট্যাঙ্ক থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি উঠে এসে আগুন নেভাতে শুরু করে। বিদ্যুৎ না থাকলেও যেন এসব মোটর এক মুহূর্ত বন্ধ না থাকে সেজন্য থাকে জেনারেটরের ব্যবস্থা। এছাড়া প্রতিটি ভবনে বিশেষ দরজা বা বেরোনোর পথ থাকে। আগুন লাগলেই ভবনের ভিতরের মানুষ এসব দরজা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারে। থাকে গ্রিলছাড়া বিশেষ জানালা।
১৯৯৩ সালে হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়,যা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ২০০৬ সালে আইনগত ভিত্তি পায়। কিন্তু বিল্ডিং কোড প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অদ্যাবধি কোনো প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয় নি।
২০০৬ সালে ফিনিক্স ভবন ধসের পর তৎকালীন সংসদে একটি আইনপাস হয়েছিল। ওই আইনে বলা আছে- যদি কেউ জাতীয় বিল্ডিং কোডের অংশবিশেষও সঠিকভাবে মানতে ব্যর্থ হন তা হলে তিনি কমপক্ষে ৭ সাত বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এমন একটি কঠিন আইন প্রণয়নের ১২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নেই। বিল্ডিং কোড হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৬ সালে। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশন জাতীয় বিল্ডিং কোড হালনাগাদের খসড়া তৈরির করে। কিন্তু এখনও তা আলোর মুখ দেখে নি।
করণীয়: পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রতিটি বহুতল ভবনের ছাদে ফলমূল, শাকসবজির এবং ওষুধি গাছের বাগান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং সোলার প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করে জাতীয় বিল্ডিং কোড সংশোধন করা উচিত। হাইরাইজ বিল্ডিং বানানোর ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচতলার ওপরে একটি করে নিরাপদ এলাকা থাকা জরুরি।
আইন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। মূলত ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা,নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা,ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ,কাছাকাছি পানির সংস্থানে গাড়ি ঢুকতে পারবে কিনা- এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্র দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপরই ওই ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজউক থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এরপর ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়। নির্মাণকাজ আংশিক বা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউকের কাছ থেকে বসবাস বা ব্যবহারের সনদ নিতে হয়। বিদেশে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মেয়রের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
নগর সরকার গঠন করে নগরের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগর সরকারের একক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এজন্যই জাতীয় নির্মাণ বিধি অমান্য করেই ঢাকা মহানগরীতে গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো বহুতল ভবন নামের মৃত্যুকূপ।