জানা যায়, ১৬১০ সালে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আর এখন তো অগ্নিকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গার্মেন্ট কারখানা থেকে হাসপাতাল, সুউচ্চভবন থেকে কলকারখানা – কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছে না আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। নিমতলি ট্রাজেডি থেকে এফআর টাওয়ার- বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেন?
কারণ-
১. গ্যাসের চুলা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, বৈদ্যুতিক ভোল্টেজের ওঠানামা, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। ১৩.৫৫ শতাংশই ঘটেছে ধূমপান থেকে। অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট থেকে। এরপরই বেশি আগুন লেগেছে চুলা থেকে। সর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর চুলা থেকে আগুন লেগেছে ২৩.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে।
২. আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের সামগ্রীর বেচাকেনা। দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
৩. অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোর্ত্তীর্ণ ব্যবস্থা থাকা।
৪. গড়িমসি করে বা দুর্নীতির কারণে অগ্নিপ্রতিরোধের পুরনো সামগ্রী না বদলানো।
৫. ভবনগুলোতে ভালোমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার না করা। বৈদ্যুতিক সামগ্রীও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বেশিরভাগ ভবনে।
৬. বস্তিতে অগ্নিকান্ডের বড় কারণ অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অনিরাপদ সংযোগ। বস্তির অধিকাংশ বাড়িতেই অবৈধ বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। এদিকে বস্তির ঘরগুলো কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি। এর ফলে একটি ঘরে আগুন লাগলে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে।
৭. দেশের ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল অগ্নিকান্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নেই অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা। যেগুলোতে আছে সেগুলোও নিয়মিত চেক আপ করা হয় না।
৮. আতশবাজি বা পটকা থেকেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
৯. বিল্ডিং কোড, সিডিএ, সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া বহু বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের জন্য এটি একটি বড় কারণ।
১০. ঢাকার আশেপাশের ও মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে অগ্নিনির্বাপন এবং উদ্ধারকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া।
১১. রাজধানী অগ্নিনির্বাপনের ক্ষেত্রে রয়েছে সক্ষমতার অভাব, আছে সচেতনতার অভাব।
১২. নগর পরিকল্পনায় রয়েছে অনেক রকমের ঘাটতি।
১৩. পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং সরু রাস্তা। এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ভয়াবহ দ্রুততার সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
১৪. তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখা। সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
১৫. প্রভাবশালীদের বাধার কারণে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
করণীয়:
১. আমাদেরকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সচেতন হতে হবে। এ জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
২. নগর পরিকল্পনায় আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা হবে। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। বিল্ডিং কোডের ব্যাপারে কোনো আপোষ করা হবে না।
৩. আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দোকান অনুমোদন দেয়া হবে না। হাসপাতালসহ বিভিন্ন সুউচ্চ ভবনে সচল অগ্নিপ্রতিরোধক সামগ্রী স্থাপন/রাখার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো হবে।
৪. ভবন নির্মাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার ও নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।
৫. অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে আলাদা ইউনিট প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট হিসেবে সেটি পরিচালিত হলে ভালো হবে। এতে কারণ শনাক্ত করতে কম সময় লাগবে। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
৬. অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক সামগ্রীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৭. আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দাহ্যপদার্থের দোকান স্থাপন করতে দেয়া হবে না; যা আছে তা তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
৮. বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। গ্যাসের চুলা ব্যবহারে আমরা অনেকসময় উদাসীন থাকি। ভালোভাবে গ্যাসের চুলা বন্ধ করতে হবে। গ্যাস লাইনে ত্রুটি বা ছিদ্র থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সচেতনতা তৈরিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
৯. আগুনের ব্যাপারে সচেতন করতে স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত প্রচারণা চালানো হবে।
১০. ষড়যন্ত্রমূলক অগ্নিকান্ডের কারণ নির্ণয় করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হবে।