নিম একটি ঔষধি গাছ। প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জন্য এত উপকারী গাছ এ পর্যন্ত আর আবিষ্কার হয়নি। এজন্য বলা হয়, নিম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বৃক্ষ। বলা হয়ে থাকে, কেউ যদি নিম গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়, কিংবা শুয়ে ঘুমায়, তাহলে তার রোগ কমে যায়, সুস্থ থাকে, মনে প্রাণে শরীরে অধিকতর স্বস্তি আসে। নিমের এসব গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। গবেষকরা বলছেন- ম্যালেরিয়া, আলসার, বহুমূত্র, চোখের ব্যথা, ক্যান্সার, হৃদরোগ, কৃমিনাশক, দাঁতের যত্ন, রাতকানা, উকুন, মাথাব্যাথা, বমি, খসখসে ও পুরনো ক্ষত -এরকম বহু রোগ নীরবে নিমের পাতা ও বাকল কার্যকর ভূমিকা রাখে।
রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ছিটানো ওষুধ যখন মশা নিধনে অকার্যকর এবং নগরবাসীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ, তখন জানা যাচ্ছে- আমাদের প্রকৃতিতে থাকা এই নিম গাছ মশা প্রতিরোধের এক মহৌষধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমে বিদ্যমান অ্যালকালাইড মশার ‘যম’। অ্যালকালাইডের কারণে মশা দূরে সরে যায়। ভেষজ গাছ নিমের পাতা এবং এর তেল মশার আক্রমণ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। রসায়নবিদ, প্রাণিবিদ, উদ্ভিদবিদ এবং কৃষি তথ্য সার্ভিস এসব তথ্যই জানাচ্ছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী- নিম ফুলের মধু অন্যান্য ফুলের মধুর তুলনায় বেশি পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণসম্পন্ন; নিম মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে। কৃষি জমির পাশে নিম গাছ লাগালে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। নিম থেকে তৈরি ওষুধ, প্রসাধনী, জৈবসার ও কীট বিতাড়ক বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ ও কাঠসহ সব অংশই রফতানিযোগ্য।
রাসায়নিক উপাদান হিসেবে নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান, যেমন-স্যাপোনিন, অ্যালকালয়েড নিমবিডিন, নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব অ্যাসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন এসব থাকে।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, নিমে ৫০টির বেশি অ্যালকালয়েড থাকে। এদের মধ্যে এজাডিরাকটিন ও নিমবিন মশা দমন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, ‘নিম গাছে অ্যালকালয়েড থাকে, যার কারণে মশা দূরে সরে যায়। শুধু মশা নয়, নানা ধরনের পোকামাকড়ও নিমের কাছে ভিড়তে পারে না। বিছানায় ছারপোকা হলে সেখানে নিম পাতা দিয়ে রাখলে ছারপোকা দূরে সরে যায়। আবার নিমের তেল গায়ে মাখলেও মশার ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।’
নিম অনেক দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। নিম বহু বর্ষজীবী মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। পূর্ণ বয়সে ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছে সারা বছর পাতা গজায়। তবে বসন্ত ঋতুতে বেশিরভাগ পাতা ঝরে যায়। ৪৫০ থেকে ১১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নিমগাছের জন্য উত্তম। তবে যেখানে বৃষ্টি কম সেখানেও নিম খুব ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়, যার প্রমাণ সৌদি আরবের পবিত্র নগরীর আরাফাতের ময়দান। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে নিম গাছ সৌদি সরকারকে উপহারে দেন।
সড়কদ্বীপে নিম নিসর্গ তৈরি করা:
এতসব গুণে ভর্তি নিম গাছ আমাদের রাজধানী ঢাকার সড়কদ্বীপগুলোত লাগিয়ে সহজেই ঢাকাকে পরিবশেবন্ধ করা সম্ভব। তখন গ্রীষ্মের খরতাপে ওষ্ঠাগত জীবনে চোখ জুড়িয়ে যাবে চিরহরিৎ বৃক্ষ নিমের ঝিরিঝিরি সবুজ পাতার পানে চেয়ে। রোদে পোড়া মানুষ একটু জিরিয়ে নেবে এর ছায়ায়। সবুজে ভরে উঠবে আমাদের ঢাকা মহানগরী।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নিম গাছ বাতাসকে জীবাণুমুক্ত রাখে। তাছাড়া এই গাছ বাতাস অনেক ঠাণ্ডা রাখে। তাই রাস্তার মাঝের ফাঁকা অংশে অথবা পাশে যদি নিম গাছ লাগানো যায় তাহলে আমরা একদিকে যেমন বিশুদ্ধ প্রকৃতি পাব, অন্যদিকে গ্রীষ্মের সময় অতিরিক্ত গরম থেকে পথিকরা রেহাই পাবে। এর ফল পাকলে মিষ্টি স্বাদের হয়। নানা রকমের পাখ-পাখালি খায় সেই ফল। যার কারণে কোনো এলাকায় একবার লাগালে নিম গাছ আর লাগাতে হয় না বরং দিনে দিনে ছড়িয়ে যাবে নিমগাছ চারদিকে।