রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতার চিত্র পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করা যায়, ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা তলিয়ে যায়। দায়িত্বে থাকা প্রতিনিধিরা বলেছেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ নিরসন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সমাধান অবশ্যই সম্ভব।
সমস্যা:
১. অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসের মহানগরী ঢাকা।
২. খালগুলো ভরাট করে পরিকল্পনাহীনভাবে বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা নগর অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক জায়গায়।
৩. ছোটবড় নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়।
৪. অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একেবারে নাজুক। কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য এখানে নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ডাস্টবিন ও কনটেইনার। যা আছে তাও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ নিয়মিত পরিষ্কার করে না বলে অভিযোগ আছে। ফলে ময়লা উপচে রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ড্রেনে গিয়ে পড়ে এবং ড্রেনে সুয়ারেজ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
৫. অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অপেক্ষাকৃত কম ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসব ড্রেনে ময়লা জমার কারণে তরল বর্জ্যের অবাধ চলাচলের পথ থাকে না। ফলে বর্জ্য মিশ্রিত বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ড্রেন উপচিয়ে রাস্তাঘাট সয়লাব করে দেয়।
৬. রাজধানী ঢাকার বিরাট অংশ এলাকা আজো ওয়াসার ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে।
৭. ঢাকার ৪টি নদী ও ৬৫টি খাল মহানগরীর পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু রাজধানীর নদী, নালা-খালসহ সব প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট ও অবৈধ দখলদারের হাতে চলে যাওয়ায় আজ তা অস্তিত্বহীন। ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। ফলে বৃষ্টির পানি ও বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য অপসারিত হতে না পেরে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। জলাবদ্ধতা ঢাকার অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮. বিভিন্ন সময়ে যেসব বক্স-কালভার্ট নির্মিত হয় তার অনেকটাই অপরিকল্পিত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি প্রয়োজনের চেয়ে সরু বক্স কালভার্টগুলো বৃষ্টির পানি অপসারণে তেমন কাজে আসে না। অনেক ক্ষেত্রে এসব কালভার্টে পলিথিনের মতো অপচনশীল কঠিন বর্জ্য আটকে গিয়ে পানি নির্গমন পথ বন্ধ হয়ে যায়।
৯. বর্ষা মৌসুম এলেই যেন সেবামূলক সংস্থাগুলো নেমে পড়ে উন্নয়নমূলক কাজের প্রতিযোগিতায়। শুরু হয় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। রাস্তার পাশের বড় বড় খাদ, মাটি ও নির্মাণ সামগ্রীর স্তুপ বৃষ্টির পানি চলাচলে বাধা দিয়ে সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতার।
১০. ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের সময় রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে ‘ইনটিগ্রেটেড ফ্লাড প্রোটেকশন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় মহানগরীর জলাবদ্ধতারোধে তেমন কোনো সাফল্য আসে নি।
সমাধান:
১. জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো হবে।
২. কঠিন বর্জ্যের সুষ্ঠু অপসারণের জন্য নগরীর বিভিন্ন স্থানে ঢাকনাসহ পর্যাপ্ত সংখ্যক বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হবে এবং এগুলোকে নিয়মিত খালি করে দূরবর্তী নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৩. বৃষ্টির পানিসহ সব রকমের তরল বর্জ্য দ্রুত অপসারণের জন্য উপযুক্ত স্থানে সঠিক ঢাল ও মাপের সিউয়ার ও সারফেস ড্রেন লাইন স্থাপনসহ বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হবে।
৪. শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমকে নিয়মিত পরিষ্কার করে সচল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে তা পয়ঃনিষ্কাশনে এবং জলাবদ্ধতারোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫. ব্যক্তিগত মালিকানায় নির্মিত হাউজ ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার রেখে ঘরের কঠিন বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যা জলাবদ্ধতা রোধে বিরাট সহায়ক হবে।
৬. রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত ডিডিসি এবং ওয়াসার কাজের সমম্বয় সাধন করা হবে।
৭. নগরীর হারিয়ে যাওয়া ও দখল হওয়া খালগুলোকে দখলমুক্ত করে যথাযথ সংস্কার করা হবে। আবার যাতে কোনো জলাধার দখল বা ভরাট না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
৮. এখনো ঢাকা মহানগরীতে হাতিরঝিলের মতো যেসব জলাধার আছে সেগুলোকে সযত্নে রক্ষা করে আরো জলাধার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করা হবে।
৯. বর্ষা মৌসুমের আগেই ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-নদী খনন, খালের তলদেশে জমাকৃত বর্জ্য এবং স্পয়েল আর্থ অপসারণ করে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারলে তা আগামীতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১০. রাজধানীর জলবদ্ধতা নিরসনে নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে।